লাখোকন্ঠ চট্টগ্রাম ব্যুরো :
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের আওতাধীন অপরাধ প্রবণ এলাকাগুলোর একটি চান্দগাঁও থানাধীন কাপ্তাই রাস্তার মাথা মোড়। শহরে প্রবেশের অন্যতম এই জংশন ঘিরে দিনভর চাঁদাবাজি, প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা চলছে। টাকা ভাগাভাগি নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ নিত্যকার চিত্র। নেপথ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী মো. আজাদ ওরফে ডাকাত আজাদের নাম উঠে আসলেও প্রশ্ন উঠছে পুলিশের ভূমিকায়।
একসময় আন্তঃজেলা ডাকাত দলের সর্দার আজাদ বিগত কয়েক বছরে অপরাধের ধরণ পাল্টে গড়ে তুলেছে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার রাম রাজত্ব। রয়েছে দুর্ধর্ষ বাহিনী, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ছড়াছড়ি। টেক্সি স্ট্যান্ডের পাশেই রেলের জমিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে গড়ে তোলা হয়েছে অপরাধের বিশাল আখড়া। আর এখান থেকেই পরিচালিত হচ্ছে আজাদের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। সরেজমিন তদন্তে জানা যায়, এখানে হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা, গাঁজা ও চোলাই মদ। ২৩ ফেব্রুয়ারী দুই কেজি গাঁজাসহ আজাদের প্রধান সহযোগী জাগির গ্রেপ্তার হয়। সন্ধ্যা নামতেই বসে জুয়ার আসরও। বিভিন্ন লোকজন তুলে এনে টর্চার করার অভিযোগ রয়েছে। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে চুরির হওয়া সিএনজি অটো রিকশা আসে আজাদের এই আস্তানায়। এরপর গাড়ির চেসিস নম্বর, ইঞ্জিন নম্বর পরিবর্তন করে বিআরটিএ-এর কথিত দালালদের যোগসাজশে জাল কাগজপত্র তৈরি করা হয়। এরপর মোটা অংকের টাকায় এসব গাড়ি বিক্রয় হয়।
শহর এলাকায় চলাচল নিষিদ্ধ গ্রাম সিএনজি অটো রিকশার সর্ববৃহৎ স্টেশন গড়ে তোলা হয়েছে কাপ্তাই রাস্তার মাথা মোড়ে। ব্যস্ত এই জংশন থেকে দিনে অন্তত দুই হাজার টেক্সি চলাচল করছে শহর ও জেলার বিভিন্ন সড়কে। গাড়ি প্রতি ছয়’শ টাকায় আজাদের কাছ থেকে প্রতি মাসে টোকেন সংগ্রহ করতে হয় চালকদের। ১০-১৫ জনের গ্রুপ লাঠি হাতে দিনভর রাস্তায় দাঁড়িয়ে চাঁদা তুলে প্রকাশ্যে। অথচ মাত্র ত্রিশ গজের মধ্যেই রয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি৷ এছাড়াও, প্রতিদিন প্রতি ট্রিপে গাড়ীপ্রতি ১০-৩০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয়া হয়। মাস শেষে এই টাকার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় কোটি টাকায়। মাসিক চাঁদা না দেয়ায় গত ৬ ফেব্রুয়ারী এক নিরীহ অটো রিকশা চালককে মারধর ও ব্লেড দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্তাক্ত করে আজাদ। ভুক্তভোগী চালক কিরণ বাদী হয়ে আজাদ ও তার সহযোগীদের নামে মামলা করেন। ৯ জানুয়ারী সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন সাংবাদিক আবুল কালাম। মারধর ও ছুরিকাঘাতের পর ক্যামেরাও ছিনিয়ে নেওয়া হয়। চুরির গাড়ি, রেজিষ্ট্রেশন বিহীন গাড়ি, এক নম্বরে একাধিক গাড়িও নির্বিঘ্নে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ‘আমার গাড়ি নিরাপদ’ কার্যক্রম ব্যাপক প্রশংসিত হলেও প্রশ্ন উঠছে, শহরে চলাচল নিষিদ্ধ গ্রাম সিএনজি টেক্সিগুলোর কি হবে। চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি, মাদক বহনসহ অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ডে এসব গ্রাম অটো রিকশার ব্যবহার বাড়ছে।
সম্প্রতি আজাদের সহযোগী শীর্ষ মাদক কারবারি হানিফকে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আটকের পরপরই কালুরঘাট ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে হানিফকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। এসময় এক নারী মাদক কারবারিও নিহত হয়। পরে পুলিশ বাদী হয়ে পৃথক দুটি মামলা করলেও ধরা ছোঁয়ার বাইরে হামলায় নেতৃত্বকারী আজাদ। আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার টাকার ভাগাভাগি নিয়ে ক’দিন পরপরই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, গোলাগুলিতে জড়িয়ে পড়ে সন্ত্রাসীরা। ঘটেছে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনাও। তবুও টনক নড়ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। ক্রমেই অপরাধ বাড়ছে রাস্তার মাথা এলাকা ঘিরে। আজাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ মোহরা এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা। তাদের চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দ পর্যন্ত করতে পারে না। বিরুদ্ধে গেলেই বাড়িঘরে হামলা তাণ্ডব চালানো হয়। আবার কখনো নিরীহ লোকজনকে তুলে নিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, মাসব্যাপী আদায়কৃত চাঁদার বড় একটি অংশ যায় প্রশাসনের অসাধু কর্তাব্যক্তিদের কাছে। সংশ্লিষ্ট থানা প্রতি মাসে দেড় লক্ষ টাকা, পুলিশ ফাঁড়ি, ট্রাফিক বিভাগসহ কথিত ক্যাশিয়ার থেকে সোর্সরাও নিয়মিত মাসোহারা নেয়। ফলে দিনে দুপুরে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধ চলছে নির্বিঘ্নে।
উল্লেখ্য, গত ২৬ জানুয়ারী চান্দগাঁও থানার অফিসার ইনচার্জ হিসেবে যোগ দেন মো. খায়রুল ইসলাম। তিনি দায়িত্ব নিতেই সংশ্লিষ্ট থানার আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। অধীনস্থ পুলিশ সদস্যরা নানা অপকর্মে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন খাত থেকে চান্দগাঁও পুলিশের মাসিক আয় অন্তত ত্রিশ লাখ টাকা। গুরুতর অপরাধেও তৎপর রয়েছে কালুরঘাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আব্দুল কাদের, কাপ্তাই রাস্তার মাথা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. আশরাফ হোসেন, বহদ্দারহাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. শফি উদ্দিন ভূইয়া, চান্দগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক আব্দুল মোনাফ, সহকারী উপ-পরিদর্শক মোহাম্মদ ইসমাইল ও কনস্টেবল ইব্রাহীম। এদের মধ্যে কাদের, মোনাফ ও ইসমাইল এ থানায় টানা পাঁচ থেকে আট বছর কর্মরত আছেন।