চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রাম নগরীতে সাম্প্রতিক সময়ে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছে চান্দগাঁও থানা পুলিশ। থানা এলাকায় আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি ঘটলেও পুলিশ ব্যস্ত ঘুষ, চাঁদাবাজি ও মাসোহারা আদায়ে। অভিযোগ উঠেছে, অফিসার ইনচার্জ খায়রুল ইসলাম যোগদানের পর থানা এলাকায় আইনশৃঙ্খলা ক্রমেই অবনতি ঘটেছে। পাশাপাশি পুলিশের মাঝে অপরাধ প্রবণতা আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিভিন্ন খাত থেকে মাসে অন্তত দুই কোটি টাকার অবৈধ আয় রয়েছে চান্দগাঁও পুলিশের। মাদক কারবারি, আবাসিক হোটেল কেন্দ্রিক পতিতালয়, ফুটপাত হকার, কাঁচাবাজার, জুয়ার আখড়া, কাঠ পাচার, পরিবহন স্ট্যান্ড, মামলা এন্ট্রি থেকে চার্জশিট, আসামী গ্রেপ্তারসহ হরেকরকম উপায়ে বাণিজ্য চলছে। এমনকি অর্থের চুক্তি ভিত্তিক জমি দখল বা বেদখল, প্রতিপক্ষের লোকজনকে মিথ্যা মামলা দেওয়া বা নিরীহ লোকজনকে জেল কাটানোর মতো ঘৃণ্য অপরাধেও জড়াচ্ছে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সদস্যরা। আর এহেন কর্মকাণ্ড অফিসার ইনচার্জের নীরব সমর্থন ছাড়া করার উপায় নেই বলে মন্তব্য বিশিষ্টজনদের।
থানায় আগত বিভিন্ন সেবাপ্রার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টাকা ছাড়া জিডি পর্যন্ত নেয় না চান্দগাঁও থানায়। পাঁচ’শ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়েছে ডিউটি অফিসারদের। আর দশ হাজারের নীচে অধিকাংশ ভুক্তভোগীদের দায়ের করা মামলা রেকর্ড হয়না। নানা গড়িমসির পর টাকা দিলে তারপর মামলা রেকর্ড হচ্ছে। এতেই শেষ নয় সেবাপ্রার্থীদের হয়রানি, আসামী গ্রেপ্তার থেকে চার্জশিট পর্যন্ত দফায় দফায় নানা অজুহাতে টাকা দাবি করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- পুলিশের বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপের ভাতিজা এসআই অসীম দাশ, এসআই দেলোয়ার হোসেন, আব্দুল মোনাফ ও লিটন।
সরেজমিন অনুসন্ধানে চান্দগাঁও থানার মাত্র পাঁচ’শ গজের মধ্যেই দেখা গিয়েছে নানা অপরাধের ভয়ংকর চিত্র। পুলিশকে ম্যানেজ করে চলছে অসংখ্য বেআইনি কর্মকাণ্ড। বিনিময়ে মাসে শেষ নির্ধারিত অংকের মাসোহারা নিয়ে যায় থানার কথিত ক্যাশিয়ার এএসআই এমদাদুল হক। তার সহযোগী হিসেবে রয়েছে কনস্টেবল সোলায়মান, জামশেদ ও আজিজ। চান্দগাঁও থানার বিপরীত পাশে অবস্থিত হোটেল টাইম ইন ও চান্দগাঁও রেস্ট হাউজ। এখানে নিয়মিত পতিতাবৃত্তি চলছেই। বহদ্দারহাট বাড়ই পাড়ার মুখে নিরিবিলি ও গুলজার আবাসিক হোটেল কেন্দ্রিক পতিতাবৃত্তি ও মাদক ব্যবসা চলছে নির্বিঘ্নে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গরীব অসহায় মেয়েদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে শহরে এনে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয় এসব আখড়ায়। থানার বিপরীত পাশে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে অন্তত ২০টি বাস কাউন্টার। প্রত্যেক কাউন্টার থেকে মাসিক চাঁদা নেয় পুলিশ। ফলে গুরুত্বপূর্ণ এই মোড়টিতে দিনভর যানজট লেগেই থাকে। থানার পশ্চিমে হাসান বেকারির সামনে গড়ে উঠেছে শহরে চলাচল নিষিদ্ধ গ্রাম সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ড। এখান থেকে অন্তত চারশো গ্রাম টেক্সি খাজা রোড হয়ে বলিরহাট পর্যন্ত চলাচল করে। তবে এসব যানবাহন পেশাদার অপরাধীদের নিরাপদ বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া, চুরির গাড়ি, এক নাম্বারে একাধিক গাড়িও চলছে। এখানকার গাড়ি চালকরা জানান, তারা গাড়ি প্রতি দৈনিক পঞ্চাশ টাকা দেয় পুলিশকে। চান্দগাঁও থানাধীন মোহরা ওয়াপদা অফিস সংলগ্ন ঝর্ণা বেগমের গাঁজার স্পট থেকে মাসিক দুই লাখ টাকা যায় চান্দগাঁও পুলিশের পকেটে। ফলে প্রকাশ্যে কাউন্টার বসিয়ে গাঁজা বিক্রি চলে রাতে-দিনে সমানে। মোহরা এলাকায় চলাচল করে অন্তত দুই হাজার নিষিদ্ধ ব্যাটারি রিক্সা ও ইজিবাইক। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে বেলাল নামে এক ব্যক্তি। মাস শেষে থানায় যায় এক লাখ আশি হাজার টাকা। বহদ্দারহাট কাঁচা বাজারের ভেতরে চলাচলের রাস্তায় অবৈধভাবে চারশো দোকান বসে নিয়মিত। নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। আর মাস শেষে থানার কথিত ক্যাশিয়ার নিয়ে যায় দুই লক্ষ টাকা। পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে ক’দিন আগে কাজিরহাট এলাকায় অবৈধ বাজার উচ্ছেদ করে চান্দগাঁও থানা পুলিশ। তবে সপ্তাহ না যেতেই ফের পুরনো চিত্র দেখা যায়। বিনিময়ে কালুরঘাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আব্দুল কাদেরকে মোটা অংকের চাঁদা দিতে হচ্ছে এসব ক্ষুদ্র দোকানীদের। পুলিশের এই কর্মকর্তা দীর্ঘ আট বছর এ থানায় কর্মরত রয়েছে টাকার জোরে।
বহদ্দারহাট নিরিবিলি ও গুলজার আবাসিক হোটেল প্রতি দৈনিক পাঁচ হাজার টাকা মাসোহারা নেয় পুলিশ। থানার সামনে বাস কাউন্টার প্রতি মাসিক নির্ধারিত অংকের টাকা দিতে হয় পুলিশকে। বহদ্দারহাট পুলিশ বক্সের পাশে সড়কের উপর চেয়ার টেবিল নিয়ে বাস কাউন্টার বসিয়ে এককালীন দুই লাখ ও মাসিক বিশ হাজার টাকা চাঁদা নেয় ফাঁড়ি ইনচার্জ সোহেল। টেম্পো স্ট্যান্ড থেকে পুলিশের নামে নিয়মিত চাঁদা তুলে সোলায়মান ও বাবুল। এইভাবে অন্তত বিশটি পরিবহন স্ট্যান্ড কেন্দ্রিক টাকা উঠানো হয় থানার নামে। চান্দগাঁও থানা এলাকায় জুয়ার আসর চলছে অন্তত দশটি। এখান থেকে দৈনিক অর্ধলক্ষ টাকা আয় পুলিশের। উল্লেখ্য, মোহরা ওয়াপদা গেইট ঝর্ণার আসর, টেকবাজারপুল রেল ক্রসিং সংলগ্ন টিপুর আসর, রাহাত্তারপুল এলাকায় সোর্স সাইফুলের আসর অন্যতম। বহদ্দারহাট এবি ব্যাংকের পাশে মাশরুম ডার্ক রেস্টুরেন্ট থেকে মাসিক পনের হাজার টাকা নেয় থানার এক উপ-পরিদর্শক। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা এখানে নিয়মিত অসামাজিক কার্যকলাপে মিলিত হতে দেখা গেছে। বহদ্দারহাট মদিনা হোটেলের সামনে থেকে নতুনব্রীজ সড়কে চলা অটো টেম্পো স্ট্যান্ড থেকে মাসিক আশি হাজার টাকা নেয় ওসির নামে, বিশ হাজার টাকা যায় ফাঁড়ি ইনচার্জ সোহেলের পকেটে। জড়িত ট্রাফিক পুলিশও। অন্যান্য স্ট্যান্ড প্রতিও বিভিন্ন অংকের মাসোহারা যায় থানায়।
এছাড়াও চোরাই কাঠ পাচারকারী সিণ্ডিকেট থেকে দৈনিক পুলিশের আয় অন্তত দুই লাখ টাকা। বিসিক শিল্প এলাকার বিভিন্ন ঝুট ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মাসিক পনের হাজার টাকা দিতে হয় কথিত ক্যাশিয়ারকে। অন্যথায় মাল বের করতে নানা বেগ পেতে হয়।
এই রিপোর্ট লেখাকালীন এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম-কে মুঠোফোনে ৩ দফায় কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।